Breaking

Sunday, February 11, 2018

মুখোশ থ্রিলার চটি সিরিজ পার্ট ১.২

রুমটা ছিমছাম। ক্যান্টিন আর রুম সার্ভিসের নম্বর গুলো বুঝে নিয়ে রুম বয়ের হাতে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট হস্তান্তরিত করে তাকে বিদায় করে দিলাম। আমি জানি কোনও হোটেলে গেলে তার রুম বয়কে একটু হাতে রাখতে হয়। তাতে অনেক সুবিধা হয়। ফোন করে চা আর ব্রেক ফাস্টের অর্ডার করে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। আমার প্রচণ্ড সকাল সকাল ওঠার অভ্যেস। শরীর চর্চার বদভ্যাস আছে। চটপট মুখ হাত ধুয়ে বেড়িয়ে এসে রোজকার মতন একটু শরীর চর্চা,প্রানায়াম, ধ্যান যোগ ইত্যাদি সেরে নিলাম। এ সবই ছোটবেলার অভ্যেস। অবশ্য মাঝে একবার শরীর চর্চায় বাঁধা পড়েছিল, কারণ রুম বয় এসে ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেল। সাধারণত অন্যান্য দিন আমি ভোর ৪ টের সময় উঠে নানা রকম শরীর চর্চার কসরত শুরু করি। সব কিছু শেষ হতে হতে প্রায় ৭ টা বেজে যায়। আজ হাতে সময় নেই। তাই কমের ওপর দিয়েই সারতে হল। ব্রেক ফাস্টে পুরি সব্জি আর একটা ডবল ডিমের অমলেট অর্ডার দিয়েছিলাম। গরম গরম থাকতে থাকতেই খেয়ে নিতে হল। হোটেলে সব খাবারের দামই বেশ চরার দিকে। মালিনী নামক মহিলাটির সামনে যতই ফাট দেখাই না কেন, মনে মনে ভালোই জানি যে এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেটে না পড়তে পারলে বেকার বিনা কারণে একগুচ্ছ টাকার ক্ষতি হয়ে যাবে। তবে এক মাসের আগে তেমন নিরাপদ আর পছন্দসই জায়গা পাব বলে মনে হচ্ছে না, কারণ শহরটাই তো সম্পূর্ণ অচেনা… অবশ্য...।



এসব চিন্তা পরে করা যাবে। আপাতত বেরতে হবে। কলেজ শুরু হতে অবশ্য এখন অনেক সময় আছে। কিন্তু অনেকগুলো কাজ এই বেলায় গুঁটিয়ে ফেলতে হবে। যে লোকটার গাড়িতে হোটেলে এসেছিলাম তাকে ফোন করলে সেই এসে হয়ত আমাকে নিয়ে যেত। কিন্তু ইচ্ছে করেই তাকে ফোন করলাম না। ঘরের এসিটা বন্ধ করে দিলাম। জানলার পর্দা সরিয়ে দেখলাম স্বচ্ছ কাঁচের স্লাইডিং উইন্ডো। কাঁচের জানলার একটা দিক ঠেলে অন্য দিকে সরিয়ে দিতেই গুমোট হাওয়া এসে মুখে ধাক্কা মারল। বাতাসে প্রচুর জলীয় বাস্প আছে সেটা অবশ্য আগের বার যখন কোলকাতায় এসেছিলাম তখনই বুঝেছি। দিন যত বাড়ে তাপমাত্রা আর জলীয় বাস্পের পরিমাণও সময়ের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে বেড়েই চলে। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে এই দিকটা হল রাস্তার দিক। মন্দ নয়। এমনটাই তো চাইছিলাম। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে জানলা দিয়ে অন্ধকার রাস্তায় লোকের যাতায়াত দেখতে মন্দ লাগবে না। আর নিঝুম রাতে অন্ধকার রাস্তা দেখার তো মজাই আলাদা। অন্ধকারে গ্রামের আর শহুরে রাস্তার সৌন্দর্যের অনেক তফাত। আমার হাত ঘড়ি নেই। একটা ট্যাঁক ঘড়ি আছে। আমার এক জন্মদিনে শান্তিদার বাবা আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। ঘড়িটা পেয়েছিলেন ওনার বাবার কাছ থেকে। ঘড়িটা পুরনো। দম দিয়ে চালাতে হয়। একটু সেকেলে বনেদি মার্কা দেখতে কারণ আজকাল এরকম ঘড়ি শুধু মিউজিয়ামে দেখা যায়। শহরে কেন, গ্রামে বা মফস্বলেও এরকম ঘড়ির চল উঠে গেছে। তবে এই ঘড়িটা কিন্তু এখনও দিব্যি চলে। শুধু মনে করে দম দিতে হয়। জন সমক্ষে যদিও এই ঘড়ি বের করে সময় দেখলে হাঁসির খোঁড়াক হতে হবে, তাই সবার সামনে সময় দেখতে হলে মোবাইলে সময় দেখে নি। আমার কাছে এখন দুটো মোবাইল। একটা ভীষণ রকম অত্যাধুনিক মোবাইল যেটা দিয়ে কি না করা যায়, আর আরেকটা হল একটা ছোট সাদা কালো রঙের নোকিয়া সেট। পরেরটা দিয়ে শুধু কল করা যায় আর এস এম এস করা যায়। ট্যাঁক ঘড়িটার মতন দামী মোবাইলটাও আমি জন সমক্ষে খুব একটা বের করি না। এক্ষেত্রে কারণ অবশ্য অন্য...ট্যাঁক ঘড়িটা দেখলে যেমন লোকে হেঁসে মরে যাবে, তেমনি এই অত্যাধুনিক মোবাইলটা দেখলে সবার চোখই টেড়িয়ে আটকে যাবে। আমার বিশ্বাস এমন মোবাইল সচরাচর বড় শহরের ছেলে মেয়েরাও চোখে দেখেনি। মোবাইলে কয়েকটা জিনিস চেক করে নিয়ে ব্যাগের মধ্যে চালান করে দিলাম। ট্যাঁক ঘড়িটা বুক পকেটে ভরতে ভরতে মনে পড়ে গেল শান্তিদার বাবার বলা কয়েকটা কথা। কথাগুলো উনি আমাকে ঘড়িটা দেওয়ার সময় বলেছিলেন। “মনে রাখিস, সময়ই মানুষকে তৈরি করে, সময়ই মানুষকে শেষ করে, সময়কে কোনও দিন অবহেলা করিস না, সময়ের আগে চলার চেষ্টা করিস না কোনও দিন, আবার সময়ের থেকে পিছিয়েও পড়িস না কখনও, সময়কে সম্মান করতে শেখ, তাহলেই সময় তোকে দেবে, সময়কে অসম্মান করলে সময় একদিন তোকে হারিয়ে দেবে। সময় সব থেকে বলবান, আর সময়ের সাথে চলতে গেলে ধৈর্য চাই...।” ছোট মোবাইলটাকে জিন্সের পকেটে পুড়ে কাঁধে একটা ছোট ল্যাপটপের ব্যাগ নিয়ে (যদিও ব্যাগটায় কোনও ল্যাপটপ নেই) ঘর থেকে বেড়িয়ে এসেছি। অবশ্য বেড়িয়ে আসার আগে টাকা পয়সা সমেত আমার সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র আর কাগজপ্ত্র আমার ঘরের দেওয়াল আলমারির লকারে নিউমারিক পাসওয়ার্ড দিয়ে লক করে রেখে এসেছি। লিফটের দিকে না গিয়ে এমারজেন্সি এক্সিটের দরজাটা খুলে সিঁড়ি বেয়েই নিচে নেমে এলাম। এই দিকটাও চিনে রাখা দরকার। আমি জানি আমি একটা আজগুবি প্রাণী। অন্য ছেলে হলে হয়ত লিফটেই নামত, কিন্তু আমার নতুন রাস্তা চিনে রাখতে ভালো লাগে। কে জানে কখন কোন কাজে লেগে যায়। গ্রাউন্ড ফ্লোরের এমারজেন্সি এক্সিটের দরজাটা খুলে যখন রিসেপসনের দিকে এগিয়ে গেলাম তখন দেখলাম দুটো বেয়ারা আর রিসেপসনে বসে থাকা মালিনী আমার দিকে একটু অবাক চোখে তাকাল। ওরা বোধহয় ভাবতেই পারেনি যে আমি এইভাবে এমারজেন্সি এক্সিট দিয়ে ভেতরে ঢুকব। আমি হেঁসে রুম কি টা রিসেপসনে ফেলে রেখে বাইরে বেড়িয়ে এলাম। অবশ্য তার আগে একটা জিনিস খেয়াল করেছি। মালিনী মাগীর শাড়ির অবিন্যস্ত ভাবটা এখন আর নেই। চোরা নজর দিয়েও ওর কোনও অনাবৃত গোপন জায়গা দেখতে পেলাম না, নাভি ক্লিভেজ, শ্যামলা রঙের তলপেট সবই এখন নিখুঁত ভাবে শাড়ির নিচে ঢাকা পড়ে গেছে। মনে মনে নিজের দুর্ভাগ্যকে গালি না দিয়ে পারলাম না।

বেড়িয়ে আসার সময়ই জানলা দিয়ে দেখে নিয়েছিলাম যে রাস্তা জনমুখর হতে শুরু করে দিয়েছে। সুতরাং একটা ট্যাক্সি পাওয়া বোধহয় খুবই সোজা হবে। মেইন গেট দিয়ে সিকিউরিটির সেলুট হজম করে বাইরে বেড়িয়ে আসতে না আসতেই অবশ্য হুঁশ করে দুটো ট্যাক্সি আমার নাকের সমানে দিয়ে বেড়িয়ে গেল। কিন্তু ওগুলোকে আটকালাম না। হোটেলের উল্টো ফুটে একটু দূরে একটা বড় পান সিগারেটের দোকান আসার সময়ই দেখেছিলাম। এগিয়ে গেলাম সেই দিকে। একটা বড় ক্লাসিকের প্যাকেট কিনে পকেটে চালান করে দিয়ে ট্যাক্সির খোঁজে এগিয়ে গেলাম। হ্যাঁ আমার বয়স কুড়ি হলেও আমি একজন চেইন স্মোকার। সজ্ঞানে থেকে ড্রিঙ্কও করতে পারি প্রচুর। অবশ্য এমন নয় যে মদ আর সিগারেট ছাড়া আমার পাগল পাগল লাগে। দিনের পর দিন সিগারেট আর মদ ছাড়াও কাটাতে আমার বিন্দু মাত্র অসুবিধা হয় না। সবই কন্ট্রোল আর অভ্যেস। তবে নেশা যে করি সেটা অস্বীকার করব না। একটা ট্যাক্সিকে হাত দেখিয়ে দাঁড় করালাম। চালক একজন বয়স্ক সর্দারজি। আমাকে জিজ্ঞেস করল কোথায় যাব। বললাম “অনেক জায়গায় যেতে হবে। আর একটু তাড়া আছে। “ আমার বয়স অল্প বলেই বোধহয় সর্দারজি কোথায় যাব সেটা আরও জোড় দিয়ে জানতে চাইল। আমিও একই রকম গা ছাড়া ভাবে উত্তর দিলাম “ধর্মতলা যাব, সেখান থেকে বালিগঞ্জ ফাঁড়ি আসব, সেখান থেকে যাদবপুর যাব, সেখান থেকে হাতে সময় থাকলে খিদিরপুর যাব।” লোকটা আমার এই বিচিত্র প্ল্যান শুনে বলল “তাহলে প্রথমে খিদির পুরেই চলুন।” আমি মাথা নেড়ে বললাম “না হে সর্দারজি। এখন খিদিরপুরে গিয়ে কোনও লাভ নেই। ওখানে গিয়ে কোনও কাজ হবে না। সময়ের আগে কোথাও গিয়ে কি লাভ!” ওর মতামতের জন্য অপেক্ষা না করেই আমি পেছনের দরজা খুলে উঠে ওর দিকে একটা ক্লাসিক সিগারেট এগিয়ে দিলাম। বললাম “ইয়ে লিজিয়ে। আর চলুন। ৫০ টাকা বাড়তি দেব। “ শেষ কথাটায় কাজ হয়ে গেল। কারণ গাড়ি গড়িয়ে চলল সামনের দিকে। সর্দারজি হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিল যে ও সিগারেট খায় না। আমি বললাম “আমি সিগারেট খেলে সমস্যা নেই তো?” সর্দারজি বয়সে আমার থেকে অনেক অনেক বড়, মাথার সব চুল পাকা। কিন্তু তাও অচেনা বয়স্ক লোকের সামনে সিগারেট খেতে আমার কোনও লজ্জা হয় না। মফস্বল হলে অবশ্য অন্য ব্যাপার ছিল। কিন্তু এত বড় শহরে এত কিছু মেনে চলার কোনও মানে হয় না। সর্দারজি আমাকে জানিয়ে দিল যে ওর সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয় নি। আমি উত্তরে বললাম “ধর্মতলায় আমার আধা ঘণ্টা সময় লাগবে। তখন নাস্তা করে নিও খন।” ব্যস এর পর আমাদের মধ্যে আর কোনও কথা হয় নি। আগেই বলেছি, প্রয়োজনের থেকে বেশী কথা বলা বা কাজ করা আমি পছন্দ করি না। নিরবে শহরের রাস্তা ঘাট মুখস্থ করতে করতে এগিয়ে চললাম ধর্মতলার দিকে।

ধর্মতলায় গন্তব্য স্থলে যখন পৌছালাম সূর্য তখন মাথার ওপরে। ট্যাক্সি ওয়ালাকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বললাম “ ওই যে বলেছিলাম এক্সট্রা পঞ্চাশ টাকা দেব, সেটা দিয়ে দিলাম। আপনি খেয়ে নিন। আমার কিছুক্ষণ সময় লাগবে।” যে বাড়িটায় ঢুকলাম সেটা ব্রিটিশ আমলে তৈরি বোধহয়। সেকেলে চেহারা। ভয় হয় একটু জোড়ে হাওয়া দিলেই হয়ত ইট পাথর সমেত পুরো ইমারতটাই ধ্বসে পড়বে। আমাকে যেতে হবে তিন তলায়। বাবার তেজারতির একটা কারবার চলে এখান থেকে। যে চালায় তাকে আমি চিনি। আগে আমাদের প্রতিবেশী ছিল। কাজ না পেয়ে বেশ কিছু দিন বসে ছিল বলে বাবা এখানে কাজের ভার দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। বেশ বিশ্বস্ত লোক তাতে সন্দেহ নেই। বয়স পঞ্চাশ ছুই ছুই। তিন কূলে কেউ নেই। শুনেছি যে খুব অল্প বয়সে একবার বিয়ে করেছিল, কিন্তু পোয়াতি বউকে হাঁসপাতালে নিয়ে যেতে দেরী হওয়ায় রাস্তাতেই ওর বউ ওর ওর বউয়ের পেটের ভিতরে বাচ্চাটা শেষ হয়ে গেছে। নাম হরিপদ। আমরা হরিদা বলেই সবাই ডাকি। হরিদার কাছ থেকে কিছু জিনিস নিয়ে আরেকজনকে দিতে হবে। হরিদা হয়ত নিজেই গিয়ে দিয়ে আসত, কিন্তু এই গদি ছেড়ে যাওয়ার জো নেই তার। দেখলাম সব কিছু তৈরি করেই রেখেছিল ও। আমাকে এক কাপ চা খাইয়েই একটা বড় ক্যাম্বিশের ব্যাগে সব জিনিস হস্তান্তরিত করে দিল। আমি ব্যাগের চেনটা খুলে জিনিস গুলো ভেতর থেকেই একবার নেড়ে ঘেঁটে দেখে নিলাম। সব ঠিক আছে। ভেতরে একটা লেদারের ব্যাগও দেখলাম। ওটাকেও একবার খুলে ভেতরে কি কাগজ পত্র আছে উপর উপর দেখে নিলাম। তেজারতির কারবারের ঝুঁকি তো আছেই, আর তার অপর বিষ ফোঁড়ার মতন আছে এক গাদা হিসেব নিকেশ। এখানকার কাজ মিটেছে। ওর ঘুপচির মতন ঘরের জানলা দিয়ে একবার বাইরে রাস্তার দিকে উঁকি মারলাম। উল্টো ফুটে আমার ট্যাক্সির চালককে দেখলাম কব্জি ডুবিয়ে মুড়ি আর ঘুগনি খাচ্ছে। এখনও খাওয়া বাকি। রাস্তাটা গাড়ি ঘোড়া আর লোক জনে ভরে গেছে। সবাই ব্যস্ত। আমার ল্যাপটপের ব্যাগটা থেকে আমার সেই মোবাইলটা বের করে সেটাকে অন করলাম। এটাকে আমি এমনিতে অফ করেই রাখি। ব্যাটারি শেষ হয়ে যাওয়ার ভয়ে নয়। এমনি রাখি। এর ব্যাটারি একবার ফুল চার্জ দিলে তিন দিনেও শেষ হয় না। হরিদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিচে নেমে ট্যাক্সিটার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে একটা হাঁসি হাঁসি মুখে সেলফি নিলাম। ওই যে বললাম বিপদ, পাশ দিয়ে যারা যাচ্ছিল সবাই আমার হাতের মোবাইলটার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকাতে তাকাতে গেল। সময় নষ্ট না করে ফেসবুকে লগ ইন করে সদ্য তোলা ছবিটা আপলোড করে দিলাম। ক্যাপশন দিলাম “ কোলকাতায় প্রথম দিন। জমজমাট ঐতিহাসিক ধর্মতলা… বেশ ভালো লাগলো… (পাঁচটা স্মাইলি)” । আসলে নতুন জায়গায় এসে একটাও সেলফি তুলে পোস্ট না করলে চলে? সময়ের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে তো! মোবাইলটা আবার অফ করে ব্যাগের ভিতর চালান দিয়ে দিলাম সযত্নে। অবশ্য অফ করার আগে কয়েকটা জিনিস চেক করতে ভুললাম না। কাজের কিছু নেই।

ধেয়ে চললাম বালিগঞ্জ ফাঁড়ির দিকে। পৌঁছাতে বেশ সময় লাগলো। ট্রাফিক বড্ড বেশী। আজ আমার কলেজের প্রথম দিন। মনে হয় ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। তবে প্রথম দিন খুব একটা কিছু পড়াশুনা হবে বলে মনে হয় না। এখানে একটা সাইবার ক্যাফের মালিকের সাথে কাজ। ভদ্রলোক এক যুগ আগে বাবার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিল। সেই টাকা আর ফেরত দেয় নি। অনেক দিন জোরাজুরি করার পর অবশেষে লোকটা বাবার কাছে দোকানটা বেচে দিয়েছে। বাবা কিন্তু লোকটাকে তাড়িয়ে দেয় নি। বাবার মন এই সব দিক থেকে ভীষণ উদার। বাবা এখন এই ক্যাফের মালিক। লোকটা ম্যানেজারির কাজ করে। আমরা সবাই একে শুভদা বলে ডাকি। উত্তর প্রদেশ থেকে বাবার সাথে এর চেনাশুনা। বাঙালি হলেও কথা বার্তায় এখনও একটা হিন্দি হিন্দি ছাপ রয়ে গেছে। আমাকে দেখেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল। অফিসের ভেতরে একটা লকার আছে। সেখানে থেকে আরেকটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিল। শালা, এই বাবার চক্করে পড়ে পড়াশুনা মাথায় উঠবে। এখানে এসে তোলাবাজির কারবারে যোগ দিয়েছি বলে মনে হচ্ছে। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ব্যাগের ভেতরটা দেখে নিলাম। শুভদা বলল “সামনে ধাবা আছে। কিছু খাবে না কি?” আমি মাথা নেড়ে বেড়িয়ে পড়লাম। ট্যাক্সিটা দেখলাম কিছু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ট্যাক্সিতে উঠে ড্রাইভারকে এক মিনিট দাঁড়াতে বললাম। সেই মোবাইলটা বের করে জানলার একদম ধার ঘেঁসে বসে রাস্তার দিকে তাক করে চারপাশের দৃশ্য সমেত নিজের আরেকটা সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে দিলাম। ক্যাপশন “ রমরমা বালিগঞ্জ। সামনের ধাবাতে একবার আসতে হচ্ছে… বেশ ভালো লাগলো।” আগের ছবিটায় দেখলাম কয়েকজন কমেন্ট দিয়েছে। কিছু সেসব পড়ার সময় এখন নয়। গাড়ি এগিয়ে চলল আর আমার মোবাইলটা আবার ব্যাগের ভিতর চালান হয়ে গেল। বালিগঞ্জ থেকে যাদবপুর পৌঁছাতে অপেক্ষাকৃত কম সময় লাগলো। পথে অবশ্য একটা ফোন করে একজনকে জানিয়ে দিলাম যে আমি আসছি। থানার ঠিক সামনে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে ধর্মতলা আর বালিগঞ্জ থেকে কালেক্ট করা ব্যাগ দুটো এক জনের হাতে তুলে দিলাম। এর নাম বাবুয়া। ফোনে কোথায় থাকবে, কি পরে এসেছে এইসব কথা হয়েই গেছিল। লোকটা বোকা বোকা মুখে একটা ধন্যবাদ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি থানার সামনেই তাকে দাঁড় করালাম। সর্দারজি থানার সামনে এতক্ষন ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রাখায় গাঁই গুই করছিল, পুলিশের ভয় আর কি, কেস দেবে! কিন্তু আমি কোনও পাত্তাই দিলাম না। এই বাবুয়াকে দেখে খুব সরল মনে হয়েছে আমার। এর সাথে একটা সেলফি না তুললেই নয়। হ্যাঁ, সেলফি তোলাটা আমার একটা নেশা। শুধু সেলফি নয়, ছবি তোলাও আমার একটা নেশা। থানাটাকে ব্যাক গ্রাউন্ডে রেখে ওর সাথে আমার একটা সেলফি তুললাম। একটা পুলিশ আমাকে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিল সেটা দেখেছি, কিন্তু ওকেও পাত্তা দিলাম না। প্রথম দিন কোলকাতায় এসে গোটা পাঁচেক সেলফি না তুললে আর কি কারণে ফেসবুক করি। ওকে ছেড়ে দিয়ে ফেসবুকে আপলোড করলাম, ক্যাপশনঃ “ কোলকাতার প্রথম বন্ধু বাবুয়া...মন্দ লাগলো না।” সময় দেখে ঠিক করলাম খিদিরপুর আজই যাব। ট্যাক্সি ছেড়ে দিল। না কোনও কেস খাই নি আমরা।

এখানে যার সাথে দেখা করব তার নাম আব্দুল। লোকটার বয়স খুব বেশী হলে ৩২। আর বেশ শক্ত পোক্ত। চা খেয়ে এর সাথে অনেক গল্প হল। ওর কাছ থেকে দুটো কাগজ ভর্তি হিসাবের ব্যাগ নিয়ে আমার ল্যাপটপের ব্যাগের ভেতর পুড়ে রওয়ানা হলাম। ঠিক হল সামনের শনিবার এসে ওর কাছ থেকে একটা বড় লেন্স কিনব। এটা আমার অনেক দিনের সখ। বাবা কে এই লেন্সের কথা আগেই বলে রেখেছিলাম। আর আব্দুলের দোকান থেকে কিনব বলেই ঠিক করা ছিল কারণ আব্দুলকেও আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। বাবারও লেন্সের আর ক্যামেরার সখ ছিল একটা বয়সে। তবে সেযুগে এত অত্যাধুনিক লেন্স বা ক্যামেরা ছিল না। বাজারে কিনতে গেলে এই লেন্সের দাম যে কত পড়বে তার কোনও ঠিক নেই। বাবা আমাকে অবশ্য একটা ভীষণ ভালো ক্যামেরা আগেই কিনে দিয়েছিল। তবে লেন্স ছিল না। বেশ একটা টেলিস্কোপিক লেন্স না থাকলে এত ভালো ক্যামেরা দিয়ে কি হবে। তবে অনেক রকমের লেন্স হয় এই জগতে। ধীরে ধীরে জমাতে হবে। হ্যাঁ আমি বড়লোক বাপের একটি মোটামুটি বিগ্রে যাওয়া ছেলে হয়ে গেছি তাতে সন্দেহ নেই। কোলকাতার বিষাক্ত বায়ুর ভেতরে এতক্ষন ঘেমে নেয়ে আর কলেজে যাওয়ার কোনও ইচ্ছে হচ্ছিল না। আর হ্যাঁ ট্যাক্সিতে ওঠার আগে ফেসবুকে একটা ছবি আপলোড করতে ভুললাম না, এইবারের ক্যাপশনঃ এই নাকি সেই খিদিরপুর, কি ভিড়রে বাবা। তবে...বেশ ভালো লাগলো…” জানি বোকা বোকা ক্যাপশন, কিন্তু এছাড়া আর কিছু মাথায় আসছে না। উঠে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললাম “চলিয়ে। যেখান থেকে আমাকে উঠিয়েছিলে সেখানেই গিয়ে আবার আমাকে ছেড়ে দাও।” ট্যাক্সির ড্রাইভার যে এই গরমে বেশ বিরক্ত হচ্ছে সেটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু ট্যাক্সির মিটার যা উঠেছে সেটা দেখেই বোধহয় মুখে কিছু বলছে না। হোটেলের কিছু আগেই আমি ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিলাম। তবে যাত্রা শেষে যখন ট্যাক্সির ভাড়াটা মেটাচ্ছিলাম তখন মনে মনে বললাম সর্দারজি, বোধহয় সারা সপ্তাহের সওয়ারির ভাড়া আজ এক বেলাতে পেয়ে গেলে। একটা সিগারেট ধরিয়ে সুখ টান দিতে দিতে বড় রাস্তা ধরে হেঁটে চললাম কলেজের দিকে। হোটেল থেকে কলেজ পায়ে হেঁটে খুব বেশী হলে ১০ মিনিট। আমার হাঁটতে খারাপ লাগে না। আর গরম যতই বেশী হোক না কেন, এই গরম আর ঘাম সহ্য করার যথেষ্ট অভ্যেস আমার আছে। এখানে রিক্সা ধরার কোনও মানে নেই। তবে আমি একটু তাড়াতাড়ি হাঁটি। তাই দশ মিনিটের রাস্তাটা যেতে আমার লাগলো ঠিক সাড়ে চার মিনিট।

সোজা চলে গেলাম কলেজের অ্যাঁকাউন্টস সেকশনে। কাউন্টার খালি দেখে কলেজ ফি জমা দিয়ে রসিদ নিয়ে, আমার ডিপার্টমেন্টে এসে ফর্ম ফিল আপ করে সব মিটিয়ে যখন ক্লাসে পৌছালাম তখন সেকন্ড হাফের ফার্স্ট ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। প্রায় পনের মিনিট পরে ক্লাসে আসায় আর তাও প্রথম দিন, স্যার যারপরনাই বিরক্ত হলেন সেটা আর বলে দিতে লাগে না। “এত লেট কেন? আর প্রথম দিনেই এই অবস্থা। তোমার তো লেজ গজাতে বেশী সময় লাগবে না হে। মনে রেখো পাশ ফেল এখানে সব আমাদের হাতে। “ আমি মাটির দিকে মুখ নামিয়ে রেখে ওনার সব তিরস্কার সহ্য করলাম। অবশ্য এখানে একটা কথা বলে রাখি, তাড়াহুড়ায় বলতে ভুলে গেছিলাম। সব ব্যাপার মিটিয়ে ক্লাসে আসার ঠিক আগে বাথরুমে গেছিলাম। সেখানে একটা আনঅকুপাইড ল্যাট্রিনের কেবিনে ঢুকে দরজা দিয়ে ব্যাগ থেকে একটা ধবধবে সাদা ফুল হাতা শার্ট আর কালো ফরম্যাল প্যান্ট বের করে চেঞ্জ করে নিলাম। শু পরেই বেড়িয়ে ছিলাম। পরনের স্টাইলিশ জিন্স আর টি শার্ট টা ব্যাগে চালান করে দিলাম। এরকম জিন্স আর টি শার্ট পরে এখানকার ছেলে মেয়েরা কলেজে আসতে পারে, কিন্তু আমার রুচিতে সেটা বাঁধে। যাইহোক স্যারের তিরস্কার শেষ হলে মাটির দিকে তাকিয়েই খুব নরম কিন্তু পরিষ্কার ভাবে বললাম “স্যার, ভুল হয়ে গেছে। আসলে উত্তরপ্রদেশ থেকে আসছি। ট্রেন অনেকক্ষণ লেট ছিল। এই পৌছালাম। কোনও মতে একটা ধর্মশালায় জিনিস রেখে রিক্সা ধরে এসেছি। আর এখানকার অ্যাঁকাউন্টসেও যা লাইন…” স্যারের বোধহয় একটু মায়া হল, “ঠিক আছে, যাও। পরের দিন থেকে লেট হলে অ্যাঁটেনড্যান্স পাবে না। নাম কি?” বললাম । স্যার একটা হুম মতন শব্দ করলেন শুধু। আমি চুপ চাপ গিয়ে একটা খালি সিট দেখে বসে পড়লাম। দরজা থেকে সিট অব্দি একবারও মাটির ওপর থেকে চোখ তুলিনি। ব্যাগ থেকে একটা খাতা আর পেন বের করে রেডি হলাম। স্যার বললেন “তোমার রোল হল ছাব্বিশ।” উঠে দাঁড়িয়ে বললাম “ওকে স্যার।” বসে পড়লাম। এত ভদ্রতা বোধহয় এখানকার শহুরে ছাত্র দের কাছ থেকে স্যারেরা এক্সপেক্ট করেন না। আমার হাবভাব দেখে বোধহয় এরা সবাই আমাকে একটা গাইয়া ভুত বলেই ধরে নিয়েছে। তাতে আমার কি বা এলো গেলো। ক্লাসে তেমন কিছুই হল না। কারণ এখন শুধু সিলেবাস দিচ্ছে। খেয়াল করলাম আমি যেমন আড়চোখে মোটামুটি সবাইকে একবার দেখে নিলাম, তেমনি অনেকেই আমাকেও ঘুরে ঘুরে আড়চোখে লক্ষ্য করছে। কারণ বোধহয় একটাই, এরকম ভদ্র ভাবে সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরে আর কেউ আসেনি। ভাগ্যিস আসার আগে মাথায় তেল ঢেলে স্নান করে আসিনি, তাহলে আর দেখতে হত না। এখানে একটা কথা বলে রাখি, গোপালবাজার না বলে উত্তরপ্রদেশ বলার কারণ একটাই। গোপালবাজার কোলকাতার তাও কাছে। বলা যায় না যদি আমারই মতন সেখান থেকে কেউ ট্রেনে এসে থাকে। তাহলে কেস খেয়ে যাব। উত্তর প্রদেশ থেকে কেউ এসেছে সেটা বিশ্বাস হয় না। আশা করছি স্যার টিকিট দেখতে চাইবেন না কোনও দিনও। চাইলে বলব চেকারের কাছে দিয়ে দিয়েছি ষ্টেশন ছাড়ার আগে।

ক্লাস শেষ হওয়ার পর মিনিট পাঁচেক সময় পেয়েছিলাম। এইবার একটু সাবলীল ভাবে সবার মুখের উপর দিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। বেশ কয়েকজনের সাথে সরাসরি চোখাচুখিও হল। সবার কথা বলার এখন কোনও মানে নেই। তবে দু একটা জিনিস চোখে পড়ল। ক্লাসে মোটামুটি একটা গ্রুপ আছে খুব বড়লোক ছেলে মেয়ের। তাদের বেশভূষাই সে কথার জানান দিচ্ছে। গ্রুপ বললাম কারণ তাদের মধ্যে এই প্রথম দিনেই যে রকম ইয়ার্কি ফাজলামি হচ্ছে আর তাও বেশ জোড়ে জোড়ে সেটা থেকে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে এরা হয় আগে থেকেই নিজেদের চেনে, অথবা, একই গোত্রীয় রক্ত বলে প্রথম দিনেই এদের মধ্যে একটা ভাব হয়ে গেছে। যাদের বেশ ভুষা সাধারণ, তারা কেমন একটা সিটিয়ে আছে প্রথম দিন বলে। আর দুই তিন জন ছেলে আর মেয়ের মুখে বেশ একটা দাদা দিদি মার্কা ভাব...মানে ইতিমধ্যে ওরা নিজেদেরকে ক্লাসের লিডার বলে ধরে নিয়েছে। পরের ক্লাস শেষ হওয়ার পর আমার পাশে বসা ছেলেটা আমার সাথে আলাপ করল যেচে। যদিও আমি প্রয়োজন ছাড়া কারোর সাথে কথা বলি না, তবুও একসাথে পড়তে গেলে কিছু অপ্রয়োজনীয় কথা বলতে হবে বই কি। আর সেটা খুব দরকারিও বটে। ওকে আমি আগেই লক্ষ্য করেছি। পরনে একটা ঢিলা ফতুয়া মার্কা শার্ট আর জিন্স। একদম সাধারণ বেশ ভুষা। কথা বার্তাও সরল। চোখে মুখে একটা সারল্য আছে। সোজাসুজি আমার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল “আমার নাম কুন্তল রাহা।” আমার নামটা এই ক্লাসের সকলের ইতিমধ্যে জানা হয়ে গেছে। ও ভীষণ গলা নামিয়ে কথা বলছে, যেন একটা ভীষণ ভয় ওকে চেপে ধরে রেখেছে। বলল “একা এসেছ?” বললাম “হ্যাঁ। বাবা গোপালবাজারে থাকে। কিন্তু এখনও দেখা হয় নি। ওর কাজের চাপ চলছে।” ও বলল “ইউপির কোথায় বাড়ি?” বললাম “মিরাট।” বলল “ সেকন্ড হাফে এসে ভালোই করেছ। টিফিনের সময় যা হল সেটা বলার নয়।” বললাম “কিরকম?” বলল “র্যাগিং।” হ্যাঁ এইটাও আমার অজানা নয়। আর এই ব্যাপারটা কি সেটা দেখার জন্য আমার ভীষণ কৌতূহলও আছে। বলল “কাল আবার হবে। টানা এক মাস ধরে হবে। “ ওর মুখটা সরল আর গোলগাল, বেশ একটু মোটার দিকেই পড়ে, শরীরটা বেশ ভারী, কারণ বেঞ্চের ওপর যখন নড়াচড়া করছে তখন প্রায় পুরো বেঞ্চটাই যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে। আর বুঝতে পারলাম কেমন জানি একঘরে হয়ে রয়েছে ছেলেটা। কারণ এই ক্লাসরুমে বেঞ্চে দুজন করে বসার জায়গা। ও বসে আছে থার্ড রো তে , কিন্তু ওর পাশে আমার আগে এসে কেউ বসে নি। কেন কে জানে। হতে পারে ভুল্লু টাইপের ছেলের সাথে যেচে পড়তে কেউ আলাপ করতে চায় না। তবে ছেলেটাকে আমার খারাপ মনে হল না। তবে আর একটু আলাপ জমানোর আগেই স্যার এসে উপস্থিত হলেন। তবে এই স্যার বেশ মিশুকে আর ভালো। সবার নাম ধাম একে একে জিজ্ঞেস করলেন। আগে কোথায় পড়তাম, কি হবি সব একে একে জিজ্ঞেস করলেন। বাড়িতে কে কে আছে, বাবা মা ভাই বোন দাদা বৌদি, এমনকি ঠাকুরদা ঠাকুমা কারোর ব্যাপারেই খোঁজ নিতে উনি বাকি রাখলেন না। এতে আমার দুটো লাভ হল। সবার বাড়ির হাঁড়ির খবর আমার জানা হয়ে গেল। একটু আগে আমার সহপাঠীদের দিকে তাকিয়ে আমার যে ধারণাটা হয়েছিল সেটা যে একদম ঠিক সেটা বুঝতে পারলাম। আর তাছাড়া খবর জোগাড় করে রাখা সব সময়ই ভালো, বলা তো যায় না কখন কোন খবরটা কাজে লেগে যায়। এই “বিশেষ” লাভটা ছাড়াও আরেকটা লাভ হল আর সেটা প্রায় অবিশ্বাস্য। পৃথিবী যে গোল সেটা যে বলেছিল সে খুব ভুল বলেনি। আর গোল মানে পুরো গোল সেটা বুঝতে পারলাম যখন আমার পাশে বসে থাকা কুন্তল ওর পরিচয় দিল। “স্যার, আমার নাম কুন্তল রাহা। বাবার নাম বিনয় রাহা। মার নাম রাধিকা রাহা। বাবা শরীর ভেঙ্গে যাওয়ায় রিটায়ারমেন্ট নিয়ে নিয়েছেন। এখন একটা মুদির দোকান দিয়েছেন। আগে কলকাতা দমকল বিভাগে ছিলেন। মা হোম মেকার। এক দিদি আছে। নাম মালিনী রাহা। বিয়ে হয়ে গেছে। দিদি একটা বড় হোটেলে কাজ করে। হবি ছবি আঁকা আর গল্পের বই পড়া। এন্ট্রান্সে র্যাঙ্ক…” স্যার অবশ্য ওকে জিজ্ঞেস করলেন যে “ কেমন ধরণের গল্পের বই পড়ার অভ্যেস। ইংরেজি না বাংলা। “ এরকম আরও কিছু। কিন্তু আমার মাথায় ঘুরছে দিদির নাম মালিনী রাহা, বড় হোটেলে চাকরি করে। এটা কি সংযোগ না অন্য কিছু। হয়ত পরে জানতে পারব ওর দিদির বিয়ের পর পদবী হয়েছে ব্যানার্জি বা মুখার্জি। ব্যস তাহলেই হয়ে গেল। আর হোটেলের নামও বোধহয় অন্য। তাও এটা একবার বাজিয়ে দেখা দরকার। ওকে স্যার বললেন তোমার আঁকা ছবি আমি অবশ্যই একবার দেখব। ও বসল আর আমি উঠে দাঁড়ালাম। “নাম সংকেত রায়।” সাথে সাথে প্রশ্ন এলো, “কিসের সংকেত।” এই প্রশ্ন শুনে শুনে আমি বোর হয়ে গেছি। হেঁসে বললাম “স্যার মুক্তির সংকেত।” স্যার বললেন “কিসের থেকে মুক্তি?” বললাম “ তা জানি না কারণ সেটা ভবিষ্যৎ বলবে। তবে আমার জন্মের পর আমার মায়ের বাতের ব্যথা ছেড়ে গেছিল। তো…” সবাই হেঁসে উঠল। বললেন “বেশ বাতের ব্যথা থেকে মুক্তির সংকেত!” বললাম “শুধু তা কেন, খারাপ জিনিস থেকে মুক্তি। বাবার নাম…” আমার পর্বও শেষ হল। অনেকের হাঁড়ির খবর মাথায় ছেপে গেছে আমার। কিন্তু আমি এখন বিশেষ ভাবে ইন্টারেস্টেড এই কুন্তলের দিদির ব্যাপারে জানতে। ক্লাস শেষ হতেই সবাই প্রায় হুড়মুড় করে বেড়িয়ে গেল। কারণটা অবশ্য বুঝতে বাকি নেই আর। র্যাগিং এর ভয়। পাছে কোনও সিনিওরের সামনে পড়ে গিয়ে ঘণ্টাখানেক ধরে নাকাল হতে হয়।

Collected  From: Here

No comments:

Post a Comment